মঙ্গলবার, ৪ নভেম্বর, ২০২৫

গোপালপুরে এইসএসসিতে চার শিক্ষার্থীর জিপিএ-৫

গোপালপুরে এইসএসসিতে চার শিক্ষার্থীর জিপিএ-৫


২০২৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় গোপালপুর উপজেলায় হতাশাজনক ফলাফলের মধ্যেও, পুরো উপজেলায় গোপালপুর সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান শাখায় জিপিএ-৫ পেয়ে আশার আলো দেখিয়েছে তিন শিক্ষার্থী।

শিক্ষার্থীরা হলেন, আলমনগর ইউনিয়নের মাদারজানী গ্রামের কৃষক মুক্তার হোসেন ও ফরিদা বেগম দম্পতির বড় ছেলে শেখ ফরিদ; পৌর শহরের সুতী পটলপাড়া এলাকার ফজলুর রহমান ও আছমা খাতুন দম্পতির কন্যা ফারজানা রহমান চৈতি; এবং হাদিরা ইউনিয়নের ভাড়ারিয়া গ্রামের নজরুল ইসলাম ও আমিনা বেগম দম্পতির বড় সন্তান মোছা. নাহিদা খাতুন।

এছাড়াও খন্দকার আসাদুজ্জামান একাডেমী থেকে কারিগরি শাখায় তাসকিন নামের এক শিক্ষার্থী জিপিএ ফাইভ পেয়েছেন।


শেখ ফরিদ জানান, আলমনগর ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৪.৮৯ জিপিএ পেয়ে এসএসসি পাস করেছিলেন। তিনি বাড়ি থেকে সাইকেলে নিয়মিত কলেজে যাতায়াত করতেন। কৃষক বাবা তাঁর পড়াশোনার খরচ জোগাতে হিমশিম খেলেও কখনও পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটতে দেননি। তাদের সামান্য জমি থেকে ১৫ শতাংশ বন্ধক রেখে বাবাই পড়াশোনার খরচ দিতেন। এবার এইচএসসিতে গোপালপুর উপজেলার সর্বোচ্চ ৫.০০ পয়েন্ট পেয়েছেন। পড়ালেখা অব্যাহত রেখে প্রশাসন ক্যাডারে বিসিএস করে বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে চান।

ফারজানা রহমান চৈতি জানান, নন্দনপুর রাধারানী পাইলট গার্লস হাই স্কুল থেকে এসএসসিতে ৫.০০ পয়েন্ট পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তাঁর বাবা ঢাকায় একটি সরকারি দপ্তরের কর্মচারী। বাবা-মায়ের উৎসাহেই ভালো পড়াশোনা করেছেন এবং এবার এইচএসসিতে সর্বোচ্চ ৫.০০ পয়েন্ট অর্জন করেছেন। ভবিষ্যতে ডাক্তার হয়ে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করতে চান।

মোছা. নাহিদা খাতুন জানান, ভেঙ্গুলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৪.৮৯ জিপিএ পেয়ে এসএসসি পাস করেছিলেন। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও দূর থেকে ভ্যান ও অটোরিকশায় নিয়মিত কলেজে যাতায়াত করতেন। তাঁর বাবা পেশায় পিকআপ চালক। বাবার স্বপ্ন, মেয়েটি ডাক্তার হোক। সেই স্বপ্ন পূরণে তিনি পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এলাকাবাসীর পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্যেই ডাক্তার হতে চান নাহিদা। এজন্য সকলের দোয়া চেয়েছেন। এবারে তিনি এইচএসসিতে ৪.৮৩ পয়েন্ট পেয়েছেন।

গোপালপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ একেএম আহসান হাবীব বলেন, গোপালপুরের শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে চায় না, নিয়মিত ক্লাস করলে আরো ভালো ফলাফল হতো। গোপালপুরে এবার ফলাফল বিপর্যয় হয়েছে, চেষ্টা করতেছি আগামীতে আরো ভালো ফলাফল করার।

গোপালপুরে ঝুঁকিপূর্ণ স্কুল ভবন, অনুপস্থিতি বাড়ছে

গোপালপুরে ঝুঁকিপূর্ণ স্কুল ভবন, অনুপস্থিতি বাড়ছে

 

মো. রুবেল আহমেদ

টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার সেনেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে পাঠদান চলায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি দিন দিন কমে যাচ্ছে। মাত্র কয়েক বছর আগেই নির্মিত বিদ্যালয়ের দুই কক্ষের ভবনটি বর্তমানে এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে যে, সম্প্রতি ক্লাস চলাকালীন সময়ে ছাদের ফ্যান পড়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আহত হন।

ভবনটির বিভিন্ন দেয়ালে ফাটল ধরেছে এবং ছাদের প্লাস্টার খুলে পড়ছে। ফলে ভবনটি এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। বিদ্যালয়ের আরেকটি পুরনো তিন কক্ষের টিনের চালা পাকা ঘরে আপাতত পাঠদান চালানো হলেও সেটিও জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে।

বৈরাণ নদের তীরে অবস্থিত বিদ্যালয়টি নদীভাঙনের ঝুঁকিতেও রয়েছে। ঘরের বারান্দার খুঁটি ভেঙে পড়েছে এবং ঘরের পাশে একটি আমড়া গাছ বিপজ্জনকভাবে দাঁড়িয়ে আছে, যা যেকোনো সময় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।


গত ২৪ সেপ্টেম্বর বুধবার বিদ্যালয়টি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপস্থিত শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল মাত্র ৮–১০ জন। তখন শুধুমাত্র ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ফজলুল হক বিদ্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন।

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ফজলুল হক বলেন,

বিদ্যালয়ে মোট ৫টি শিক্ষকের পদ থাকলেও প্রধান শিক্ষকের পদটি শূন্য। আমি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। দুইজন শিক্ষিকা মাতৃত্বজনিত সমস্যায় ছুটিতে, একজন শিক্ষকের স্ত্রীর পরীক্ষা থাকায় তিনি অনুপস্থিত। এছাড়া বিদ্যালয়ের পিয়ন একটি মামলায় কারাগারে আছেন। একা হাতে সব সামলানো কঠিন। পাঠদানের পাশাপাশি অফিসের কাজ, টিকা নিবন্ধনের কাজও করতে হচ্ছে। ফলে নিয়মিত ক্লাস নেওয়া যাচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, আমি এখানে নতুন যোগ দিয়েছি। ভবনগুলো এতটাই জরাজীর্ণ যে অভিভাবকরা সন্তানদের পাঠাতে ভয় পান। বিদ্যালয়ে ৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থী থাকলেও নিয়মিত উপস্থিত থাকে মাত্র ২০–২৫ জন। বিদ্যালয়ের জন্য নতুন ও নিরাপদ ভবন নির্মাণ এখন খুবই জরুরি।

বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি গোপালপুর উপজেলা শাখার সভাপতি বিলকিস সুলতানা বলেন, ফ্যান পড়ে আহত হওয়ার ঘটনায় আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটি ব্যবহার না করার জন্য বলেছি। পাশাপাশি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে নতুন ভবনের জন্য লিখিত আবেদন করার পরামর্শ দিয়েছি। শিক্ষক অনুপস্থিতির বিষয়টি জানিনা।

গোপালপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. মফিজুর রহমান বলেন, উপজেলার সকল ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয়ের তালিকা তৈরি করে ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। শিক্ষক অনুপস্থিতির বিষয়েও খোঁজ নিবো।

প্রাচীন শহর গোপালপুর : ইতিহাস,ঐতিহ্য ও আধুনিক উন্নয়নের গল্প

প্রাচীন শহর গোপালপুর : ইতিহাস,ঐতিহ্য ও আধুনিক উন্নয়নের গল্প


ঐতিহাসিকদের মতে, ১৯০৪ সাল পর্যন্ত গোপালপুর মৌজা ছিল হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। সেসময় হিন্দু মহাজনরা বৈরাণ নদের তীরে নন্দনপুর এলাকায় পাটের কারখানা গড়ে তুলেছিলেন। তখন গোপালপুর থেকে বৈরাণ নদ দিয়ে পাটবোঝাই সারি সারি নৌকা যেত কলকাতায়। পরবর্তীতে নারায়ণগঞ্জ আদমজী পাটকলে পাট পাঠানো হতো এই বৈরাণ নদী দিয়েই।

উইকিপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী, গোপালপুর থানা গঠিত হয় ১৯২০ সালে; থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৩ সালে এবং গোপালপুর পৌরসভা গঠিত হয় ১৯৭৪ সালে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা থেকে টাঙ্গাইলকে আলাদা জেলা ঘোষণা করা হলে গোপালপুর থানা টাঙ্গাইল জেলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।


গোপালপুরের অর্থনীতি

সেকালে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল ছিল পাট চাষের জন্য বিখ্যাত। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান হাতিয়ারসোনালী আঁশপাট ছিল গোপালপুরের প্রধান ফসল।
জানা যায়, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ভারত পাকিস্তান আলাদা দেশ সৃষ্টি হয়। এরপর দুই দেশের দ্বন্দ্বে কলকাতায় পাট রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকার নারায়ণগঞ্জে গড়ে ওঠা পাটকলে পাট পাঠানো শুরু হয় গোপালপুর থেকে।

যমুনা লাগোয়া গোপালপুর অঞ্চল যমুনার পাড়ে বেরিবাঁধ না থাকায় বছরের বেশিরভাগ সময় পানির নিচে থাকতো এই অঞ্চল । প্রতি শনিবার গোপালপুর হাটে নৌকায় পাট এনে বিক্রি করতেন কৃষক ফড়িয়ারা। পাট বিক্রি শেষে গরম জিলাপি কিনে ফিরতেন বাড়ি। শুকনো মৌসুমে ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি, মহিষের গাড়ি পরবর্তীতে সাইকেলে কৃষিপণ্য হাটে নিয়ে আসা হতো।

বিভিন্ন গ্রাম থেকে অনেকেই হেঁটে আসতেন থানা সদরে। বর্ষা মৌসুমে গোপালপুর হাটের কালিমন্দির সংলগ্ন ঘাট, গোপালপুর থানা সংলগ্ন ঘাট নন্দনপুর ঘাটে সারিবদ্ধভাবে বাঁধা থাকতো শত শত নৌকা। বরিশাল অঞ্চল থেকে আসতো নৌকাভর্তি নারিকেল, আর গোপালপুর থেকে রপ্তানি হতো পাট। বৈরাণের ঢেউয়ে ছড়াতো মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।

তখন গোপালপুর হাট ছিল অত্র অঞ্চলের অন্যতম দাপুটে হাট। বর্ষার কারণে পর্যাপ্ত ধান উৎপাদন না হওয়ায় মানুষ খাদ্যকষ্টে জীবনযাপন করতো। তবে ডোবা, খাল, বিল, বৈরাণ ঝিনাই নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। সেসময় মাইলের পর মাইল হেঁটে দূরের বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হতো।
বিলাসী বিনোদনের মাধ্যম ছিল পুরুষরা নারীর পোষাকে গাইতো বেহুলা নাচারি, জারিসারি, যাত্রাপালা গান এবং কলের গান রেডিও; বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হতো বাইসাইকেল।


গোপালপুরের পরিবর্তন

মুক্তিযুদ্ধের সময় গোপালপুর থানায় অবস্থানরত বাহিনীর ওপর দুঃসাহসিক হামলা চালান ১৩ বছর বয়সী সুতি পলাশ গ্রামের শহিদুল ইসলাম লালু। তিনি ছিলেন গোপালপুরের একমাত্র বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত এবং সারাদেশের সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা।

স্বাধীনতার পর কয়েক দশকে বদলে যেতে থাকে গোপালপুরের চিত্র। ধীরে ধীরে উন্নত হয় যোগাযোগ ব্যবস্থা; নির্মিত হয় বিভিন্ন উপজেলার সঙ্গে সংযোগ সড়ক ভূঞাপুরতারাকান্দি বেরিবাঁধ। শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত হয়, সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থান। আশির দশকে তৈরি হতে থাকে গ্রামীণ সড়ক, ফলে যমুনার পানি অবাধ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়যা গোপালপুরের সমাজ কৃষিতে নতুন পরিবর্তন আনে।

বর্তমানে পাটের আবাদ কমিয়ে ধান উৎপাদনে ঝুঁকেছেন কৃষকরা। এখন গোপালপুরের প্রধান অর্থকরী ফসল ধান, তবে ভুট্টা সরিষা চাষও বাড়ছে। একসময় প্রতি বিঘায় - মণ ধান উৎপাদন হতো, এখন উন্নত প্রযুক্তিতে ৩০-৩৫ মণ পর্যন্ত হচ্ছে। এছাড়া প্রবাসী পোশাকশ্রমিকদের আয়ে গোপালপুরের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।

এখন আর এই অঞ্চলের মানুষকে না খেয়ে জীবনযাপন করতে হয় না। একসময় ছনের ছাপড়া ঘরে মানুষ বাস করলেও বর্তমানে চারচালা টিনের ঘর পাকা বাড়ি বেড়েছে।


খেয়াঘাটের বিড়ম্বনা

আশির দশকে বিভিন্ন গ্রামীণ রাস্তাঘাট নির্মিত হলেও বর্ষাকালে খেয়াঘাটে ছিল চরম বিড়ম্বনা। বৈরাণ নদীর ওপর গোপালপুর থানা সংলগ্ন, কোনাবাড়ি বাজার কালিমন্দির সংলগ্ন, সুতি বলাটা, ঝাওয়াইল, নবগ্রাম ভেঙ্গুলা এলাকায় ছিল বড় বড় খেয়াঘাট। এসব ঘাটে খেয়ানৌকায় পারাপার হতো, কখনো ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হতো।

জরুরি রোগী পারাপারে ভোগান্তি ছিল নিত্যদিনের। গোপালপুর পোস্ট অফিস সংলগ্ন নদী পারাপারে ছিল বাঁশের সাঁকো। খাল নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে অসংখ্য সাঁকো স্থাপন করা হতো।

১৯৯৩ সালে গোপালপুর থানা সংলগ্ন ব্রিজ উদ্বোধনের পর যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। এরপর ঝাওয়াইল বেইলি ব্রিজ, সুতি বলাটা, ভেঙ্গুলা, নবগ্রামসহ ছোট ছোট ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণ হয়। ফলে ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি মহিষের গাড়ি বিলুপ্ত হয়ে পায়ে চালিত ভ্যান রিকশার প্রচলন শুরু হয়।

 

যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তন

নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে গত তিন দশকে গোপালপুরে ব্যাপকভাবে ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ রাস্তা পাকাকরণের কাজ শুরু হয়। এতে গোপালপুরের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বেড়েছে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল সিএনজি চালিত অটোরিকশা। এছাড়াও প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, বাস ট্রাকের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
যমুনা সেতুর পূর্ব দিক থেকে জামালপুরের সরিষাবাড়ী পর্যন্ত নির্মিত রেললাইন গোপালপুরে রেল যোগাযোগের নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে।


শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন

একসময়ের অবহেলিত শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা জনপদ গোপালপুরে শিক্ষিতের হার ছিল অত্যন্ত কম। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে গোপালপুরের শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন শুরু হয়। উন্নত মানের শিক্ষা সরকারিভাবে নিশ্চিত করা হচ্ছে।
মাদরাসা, প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয় কলেজ এমপিওভুক্ত বা সরকারিকরণের ফলে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বহুতল ভবন নির্মাণ, বিনা বেতনে পড়াশোনার সুযোগসব মিলিয়ে গোপালপুরে শিক্ষিতের হার ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় তৎকালীন বিএনপি সরকারের উদ্যোগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চালু করাশিক্ষার বিনিময়ে খাদ্যকর্মসূচির আওতায় শিক্ষার্থীদের গম চাল বিতরণ করা শুরু হলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
এছাড়াও মাধ্যমিক বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত মাদরাসায় নারী শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি চালু হলে নারীদের শিক্ষায় অংশগ্রহণ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এখনো প্রাথমিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উপবৃত্তি কার্যক্রম চালু রয়েছে।


ডাক টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তন

২০০০ সালের আগে গোপালপুরে ডাক ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী যোগাযোগ মাধ্যম। অফিস, আদালত ব্যক্তি পর্যায়ে যোগাযোগের জন্য ডাকঘর ছিল খুব জনপ্রিয়, যাকে সবাইপোস্ট অফিসবলতো।

গোপালপুর মেইন রোডের পাশে ডাকঘরের সামনে স্থাপিত ছিল চার ফুট লম্বা ডাকবাক্স, যেখানে প্রতিদিন শত শত মানুষ চিঠি ফেলতো। কেউ কেউ আবার নির্দিষ্ট ফি দিয়ে রেজিস্ট্রি ডাক পাঠাতেন। পোস্ট অফিসের দক্ষিণ পাশে ছিল টেলিফোন টেলিগ্রাম অফিস। এখান থেকেই ঢাকা চট্টগ্রামে তারযোগে বার্তা পাঠানো হতো। টেলিগ্রাম মাস্টারেরহ্যালো, হ্যালোবলে চিৎকারের সেই শব্দ আজো অনেকে স্মরণ করেন।

১৯৯৯ সালের পর গ্রামীণফোনের সেবাপল্লীফোনগ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের মাধ্যমে গ্রামের বিভিন্ন দোকান বাজারে স্থাপিত হতে থাকে। এর মাধ্যমে দেশ-বিদেশে থাকা আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হয়ে যায়। তখন কেউ ফোন এলে পল্লীফোনের মালিকরা মাইকে ডেকে দিতেন, এবং কল ব্যবহারের জন্য মিনিটপ্রতি ফি দিতে হতো।

২০০০ সালের পর ব্যক্তি পর্যায়ে মোবাইল ফোনের ব্যাপক প্রচলন ঘটে। স্মার্টফোন উদ্ভাবনের ফলে ডিজিটাল যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। এতে ডাক বিভাগের জনপ্রিয়তা কমে যায়।

বিনোদনের একাল-সেকাল

গ্রামীণ বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল পুঁথি পাঠ, বাউল গান, ধুয়া গান, জারি-সারি, মঞ্চনাটক যাত্রাপালা। সত্তরের দশকের পর কোনাবাড়ি বাজারেরকাকলি সিনেমা হলএবং নন্দনপুরেরমানসী সিনেমা হলব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

বর্তমানে স্মার্টফোনের দাপটে সেই জনপ্রিয় মাধ্যমগুলো হারিয়ে গেছে। গোপালপুরের কাকলি মানসী সিনেমা হল এখন বন্ধ।

বিনোদনের আরেকটি বড় মাধ্যম ছিল খেলাধুলা। তখন হাডুডু, লাঠিখেলা, গোল্লাছুট, বৌছি, কানামাছি, দাঁড়িয়াবান্ধা, কুত-কুত, সাতচারা, ডাংগুলি, এক্কা-দোক্কা নৌকা বাইচ অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। পরবর্তীতে ফুটবলও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম শিক্ষার্থীরা স্মার্টফোন আসক্তির কারণে এসব ঐতিহ্যবাহী খেলা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। গেমস আসক্তি মাদকাসক্তি এখন তরুণদের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গোপালপুরের উত্থান-পতন

বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন জনপদ গোপালপুর। ১৯১৪ সালে জেলা উত্তরাঞ্চলের পুলিশ হেডকোয়ার্টার স্থাপনের প্রস্তাবনাও ছিল এখানে। পাট পশুসম্পদ বিক্রির জন্য বিখ্যাত ছিল গোপালপুর হাট। বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ দলবেঁধে হাটে আসতো।

পরবর্তীতে পাটের আবাদ বিক্রি কমে যাওয়ায় গোপালপুর হাটের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। বিভিন্ন মোড়ে নতুন বাজার গড়ে ওঠায় গোপালপুর হাট তার পুরনো গৌরব হারায়।

লোকমুখে প্রচলিত আছে— “জমি দলিল হাসপাতালের জরুরি দরকার ছাড়া গ্রামের মানুষ গোপালপুর শহরে আসতে চায় না।

এক সময়ের মানুষ কেরোসিন তেলের কুপি হারিকেনের উপর নির্ভরশীল থাকলেও বর্তমানে বাড়ি বাড়ি বিদ্যুৎ পৌঁছে যাওয়ায় অধিকাংশ ঘরে টেলিভিশন ফ্রিজের ব্যবহার দেখা যায়।

গোপালপুরে যা জরুরি দরকার

প্রাচীন এই জনপদটি হাইওয়ে-সংলগ্ন না হওয়ায় পার্শ্ববর্তী উপজেলার মানুষের যাতায়াত এখানে খুবই কম। হেমনগর আলমনগর ইউনিয়নের বড় অংশের মানুষ কেনাকাটার জন্য ভুঞাপুরে যান। মির্জাপুর ইউনিয়নের মানুষ ঘাটাইলে, ধোপাকান্দি ইউনিয়নের অনেকেই মধুপুরে এবং হাদিরা ধোপাকান্দির একাংশের মানুষ ধনবাড়ীতে যান। এতে গোপালপুর শহর বাণিজ্যিকভাবে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে বলে মনে করেন বিজ্ঞজনরা।

উত্তরাঞ্চলের গণপরিবহনগুলো এলেঙ্গা হয়ে ময়মনসিংহ যায়। এসব পরিবহন ভুঞাপুর হয়ে গোপালপুরের মধ্যে দিয়ে চলাচল করলে যাত্রীসেবা সহজ হবে। একইভাবে সরিষাবাড়ী তারাকান্দির পরিবহনগুলো পিংনাঝাওয়াইলগোপালপুর হয়ে ঢাকা যেতে পারে। এতে তেল খরচ বাঁচবে এবং সময়ও কম লাগবে। গোপালপুর হয়ে উঠবে জনবহুল এলাকা।

যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হলে প্রাচীন জনপদ গোপালপুরের চেহারা বদলে যাবে। এখানে এখনো কোনো আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। তাই গোপালপুরে বিশ্বমানের মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি গবেষণা কেন্দ্র আইটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন অত্যন্ত জরুরি।

যমুনা নদীর তীরে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন কলকারখানা গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে।
এখন যেহেতু গোপালপুরে পর্যটকের আগমন বাড়ছে, এখানে একটি আন্তর্জাতিক মানের বিনোদন পার্ক নির্মাণেরও সুযোগ রয়েছে।

খালগুলোতে অবাধ পানি প্রবাহে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। কৃষিজমি রক্ষায় প্রতিটি খাল পুনঃখনন করে পানিপ্রবাহ অব্যাহত রাখা জরুরি। এসব পরিকল্পনা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে গোপালপুরের মানুষের ভাগ্য যেমন বদলে যাবে, তেমনি বদলে যাবে এই অঞ্চলের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট।

গোপালপুরের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়া

হেমনগরের জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরীর পরিত্যক্ত জমিদারবাড়ি ছাড়া গোপালপুরে উল্লেখযোগ্য স্থাপনা তেমন ছিল না। আশেপাশের উপজেলার মানুষ নৌকায় এসে এখানে পিকনিক করতো।

সম্প্রতি দক্ষিণ পাথালিয়া গ্রামে নির্মিত ২০১ গম্বুজ মসজিদ সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন মসজিদটি দেখতে আসেন। এতে গোপালপুর উপজেলার পাশাপাশি টাঙ্গাইল জেলার সুনাম নতুনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রফিকুল ইসলাম কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে ২০১৩ সালে দক্ষিণ পাথালিয়া গ্রামের সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ মো. রফিকুল ইসলাম ২০১ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এই মসজিদটির কারণেই গোপালপুর সারাদেশে নতুনভাবে পরিচিতি লাভ করেছে।

মোরুবেল আহমেদ,

গণমাধ্যমকর্মীতথ্য  প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদকগোপালপুর প্রেসক্লাব, টাঙ্গাইল।